আধ্যাত্মিকতা অর্জনের জন্য আমাদের অতীতের মনীষীদের কাছে ফিরতে হবে। অথচ আধ্যাত্মিকতাও জীবিত মানুষের কাছ থেকে অর্জন করা যায়। গবেষক আলেমরা বলেন, আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিকতা জীবিত মানুষের কাছ থেকেই অর্জন করতে হয়। তাঁদের থেকেই তা পুরোপুরি অর্জন করা সম্ভব।তাঁরা বলেন, জীবনে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন আছে, জীবনে বৈচিত্র্য আছে, সময়ে এক রং তৈরি হয় এবং সময়ে আরেক রঙের বিদায় হয়, এক রোগের সৃষ্টি হয় এবং অপর রোগের বিদায় হয়। সুতরাং চলমান পৃথিবী ও বাস্তবতার সঙ্গে যার সম্পর্ক নেই সে গতিশীল ও সমকালীন মানুষের নেতৃত্ব দিতে পারে না। এমন ব্যক্তির মাধ্যমে উপকৃত হওয়া সম্ভব, তবে সে সময়ের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য নয়। কোনো জাতির বহু কিছু আছে; বড় বড় পাঠাগার আছে, সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে, কিন্তু জাগ্রত চেতন ব্যক্তিত্ব নেই—যার হৃদয় থেকে, যার গবেষক মন থেকে, পাণ্ডিত্য থেকে ও যার দূরদৃষ্টি থেকে আমরা আলো গ্রহণ করব।এমন জাতির ভবিষ্যৎ কী?
বিশুদ্ধ হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহ প্রত্যেক শত বছরে এই উম্মতের জন্য একজন ব্যক্তি প্রেরণ করেন—যিনি তাদের দ্বিনি বিষয় সংস্কার করেন।’ অর্থাৎ আল্লাহ প্রত্যেক শতাব্দীতে একজন সংস্কারক পাঠান, যিনি দ্বিনকে সজীব ও গতিশীল করেন এবং দ্বিনি সংস্কারের দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিনি সংস্কার কোনো সাময়িক বিষয় নয়, যা এক-দুই সপ্তাহে শেষ হয়ে যাবে; বরং তা একটি চলমান প্রক্রিয়া। ইসলামের ইতিহাসে এমন বহু মনীষী রয়েছেন, যাঁদের প্রভাব কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
রেললাইনে মানুষ একটি ছোট গাড়ি চালাত, সম্ভবত তা এখনো চলে—যার নাম ট্রলি। প্রথমে মানুষ তাতে ধাক্কা দেয়। এরপর তাতে বসে যায় এবং তা চলতে থাকে। গতি কমে গেলে নেমে আবার ধাক্কা দেয় এবং তাতে বসে পড়ে। এই উম্মতের গাড়িও অনুরূপ।আলেম ও মুজাদ্দিদরা হলেন ধাক্কা দানকারী। তাঁরা উম্মতকে সামনের দিকে ঠেলে নিয়ে যান। একবার ধাক্কা দিয়ে তাঁরা থেমে যান না। একবার ধাক্কা দিলেই তা চলতে থাকে না। গাড়ি নিজের চাকার ওপরই এগিয়ে যায়। তবে তাকে এগিয়ে নিতে একজন জাগ্রত চেতন মানুষের প্রয়োজন হয়। উম্মতকে সামনে এগিয়ে নিতে কোনো প্রযুক্তি যথেষ্ট নয়। ট্রলি চলতে দুটি জিনিসের প্রয়োজন হয়—এক. গতিশীল চাকা, দুই. ধাক্কা দেওয়ার জন্য শক্তিশালী হাত। আবার যে ব্যক্তি তার ওপর বসা থাকে তাকেও শক্ত হয়ে বসে থাকতে হয়—যেন পড়ে না যায়। এই জাতি যখন গতি হারায় এবং পাপ কাজে লিপ্ত হয়, আল্লাহ তাদের জন্য একজন সংস্কারক পাঠান, যিনি তাদের ধাক্কা দিয়ে গতি সৃষ্টি করেন।
আমি মুজাদ্দিদে আলফে সানি (রহ.) ও শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.)-কে এই সময়ের মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক মনে করি। আমি মনে করি, যেখানেই দ্বিনি জ্ঞানের চর্চা আছে, যেখানেই সুন্নতের দাওয়াত আছে, যেখানেই শিরক ও বিদআত পরিহারের অনুপ্রেরণা ও তার প্রতি ঘৃণা আছে, তা এই দুই মহান ব্যক্তির প্রচেষ্টার ফসল। মুজাদ্দিদ আলফে সানি (রহ.) ইসলামের ইতিহাসে এমন একজন মনীষী ছিলেন, যিনি উম্মতের গাড়ি এমন জোরে ধাক্কা দিয়েছেন যে সাড়ে তিন শ বছর যাবৎ তা চলছে এবং আল্লাহ ভালো জানে তা কত দিন চলবে। তাঁর দেড় শ বছর পর শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.)-এর পরিবারের সদস্যদের বিকাশ ঘটে। তাঁরা ভারতবর্ষে দ্বিনচর্চায় অসামান্য অবদান রাখেন। তাঁদের সবচেয়ে বড় অবদান দ্বিনি চেতনা জাগ্রত করা। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান দায়িত্ব জাগ্রত চেতন মানুষ তৈরি করা। তাঁরা এই কাজটিই করেছিলেন। এখন মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সময়সচেতন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব তৈরি করা। যারা সমকালীন সংকটগুলো বুঝবে এবং কোরআন-সুন্নাহর আলোকে তা সমাধান করতে পারবে। যারা সময়ের দাবি অনুযায়ী উম্মাহকে সঠিক পথ দেখাতে পারবে।
তামিরে হায়াত থেকে মো. আবদুল মজিদ মোল্লার ভাষান্তর
অজ্ঞতাই মুসলিম সমাজের বিভ্রান্তির মূল কারণ
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে একটি সুন্দর সমাজ গঠন করা সম্ভব। কারণ শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন এমন এক সময়ে, যখন বিশ্বের অন্যতম প্রাচীনতম জনপদ মক্কানগরীর অধিবাসীরা ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের বাসিন্দা।যে যুগটাকে অন্ধকারের যুগ বলে অভিহিত করা হয়েছে ইতিহাসে।
নবুওয়ত পূর্ববর্তী সময়ে যুবক মুহাম্মদ (সা.) যুদ্ধপ্রিয় মক্কাবাসীদের অহেতুক রক্তপাত থেকে বিরত রাখতে বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণ, সংস্কারকৃত কাবাঘরের কালো পাথর (হাজরে আসওয়াত) প্রতিস্থাপন নিয়ে সৃষ্ট মতবিরোধে তার দেওয়া সর্বজনগ্রাহ্য সমাধান প্রমাণ করে- তিনি আগামীর একজন দিকপাল ও নেতা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলছেন।
নবুওয়ত প্রাপ্তির পরেই নবী মুহাম্মদ (সা.) এক আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের জন্য আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন মক্কাবাসী থেকে শুরু করে বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানালেন নারীকে সম্মানজনক আসন ও তাদের ন্যায্য অধিকার দেওয়ার।
জীবনভর তিনি এই আহ্বান এবং অধিকারের কথা বলেছেন- তা অব্যাহত ছিল ইসলামের চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত। বিদায় হজের ভাষণেও তিনি সেই অধিকারের কথা ব্যক্ত করে গেছেন।
মক্কার জীবনে নবী মুহাম্মদ (সা.) যে সংস্কার অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আলোকিত সমাজ গড়ার কর্মকাণ্ড শুরু করেছিলেন, হিজরত পরবর্তী মদিনায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের পর তা আরও বেগবান এবং আধুনিকায়ন করার প্রয়াস অব্যাহত থাকে। মদিনায় নবী মুহাম্মদ (সা.) শুধু ধর্মীয় নেতা হিসেবে নন, সর্বস্তরের একজন সফল নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন।
নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর দেখানো পথ, বলে যাওয়া আদর্শ বিশ্ববাসীর জন্য আদর্শ। যে আদর্শের অনুসরণে রয়েছে মুক্তি ও শান্তি।
আমরা জানি, বর্তমান বিশ্ব আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত। কিন্তু শান্তির অন্বেষায় মুসলমানরা রাসূলের আদর্শের অনুসরণ বাদ দিয়ে আধুনিকতার স্রোতে গা ভাসিয়ে শান্তি খুঁজে বেড়াচ্ছে। এমনকি অনেক মুসলমান মহানবী (সা.)-এর আদর্শকে নেহাতই ধর্মীয় আদর্শ এবং এটাকে একান্তই ব্যক্তিগত বিষয় মনে করছে। সেই সঙ্গে ভাবছে, ইসলামের শিক্ষা প্রগতির অন্তরায়। ফলে মুসলিম সমাজে বিপথগামী সভ্যতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষতার যুগে নবী করিম (সা.)কে আমরা কতটুকু অনুসরণ করতে পারছি একবার যদি বিবেককে প্রশ্ন করা হয়, তাহলেই উত্তর পাওয়া যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা এমন গভীরভাবে পাপে নিমজ্জিত যে আমাদের বিবেক বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সব শ্রেণিপেশার মানুষের জন্যই কথাটি প্রযোজ্য (পর্যাপ্ত ব্যতিক্রমও আছে)।
বস্তুত ইসলাম যে সব সময় একটি সর্বোত্তম আদর্শ এবং মহানবী (সা.) সে আধুনিকতার প্রচার এবং তার জীবদ্দশায় বাস্তবায়িত করেছেন- সে সম্পর্কে অজ্ঞতাই বর্তমানের মুসলিম সমাজের বিভ্রান্তির মূল কারণ। মুসলমানদের এমন অজ্ঞতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জ্ঞান দ্বারা আলোকিত হতে হবে।
মনে রাখতে হবে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রচারিত ধর্ম ইসলাম শুধুই একটি ধর্মমত নয়, বরং এটি আধুনিকতার সংমিশ্রণে প্রণীত একটি প্রগতিশীল জীবন বিধান। যার বাস্তব অনুসরণের মাধ্যমে একটি সুন্দর, আদর্শ, সুখী ও শান্তিময় সমাজ গঠন করা সম্ভব।
+ There are no comments
Add yours