দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়ন রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন ও যথাযথ ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে। তাই ইসলাম রাষ্ট্রীয় সম্পদ যথার্থ ও ন্যায়সংগত ব্যবহার নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছে। মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ (সা.) রাষ্ট্রীয় সম্পদের সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত করার প্রয়াস পান। একইসঙ্গে তিনি রাষ্ট্রীয় সম্পদের সব ধরনের অপব্যয় ও অপরিণামদর্শী ব্যবহার বন্ধের উদ্যোগ নেন।
রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে মহানবী (সা.) অর্থ প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং সম্পদের প্রবাহকে তিনি নিয়মাধীন করেন। যেন সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা যায়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সম্পদ যেন তোমাদের ধনীদের হাতে কুক্ষিগত হয়ে না যায়। ’ (সুরা : হাশর, আয়াত : ৭)
রাষ্ট্রীয় সম্পদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে মহানবী (সা.) ও পরবর্তী খলিফাদের কর্মপদ্ধতি থেকে যেসব নির্দেশনা পাওয়া যায় তার একটি সংক্ষিপ রূপরেখা তুলে ধরা হলো।
কেন্দ্রীয় অর্থব্যবস্থা:
ইসলামী রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় অর্থব্যবস্থার নাম বায়তুল মাল। মহানবী (সা.)-এর মাধ্যমেই ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম কেন্দ্রীয় অর্থব্যবস্থা গড়ে ওঠে। মহানবী (সা.) অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কর্মী নিয়োগ দিতেন এবং তার কাছেই রাষ্ট্রের সমুদয় সম্পদ একত্র হতো। তবে সে সময় ইসলামী কেন্দ্রীয় অর্থব্যবস্থার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক নাম ছিল না।
খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর এই কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার নামকরণ ‘বায়তুল মাল’ করা হয়। তিনি পূর্ণাঙ্গ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। (ইমাম তাবারি, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক : ২/৫১৯)
ইসলামী অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয়ে সুসংহত কেন্দ্রীয় অর্থব্যবস্থা অপরিহার্য। শুধু সম্পদ পুঞ্জীভূত করা বা রক্ষণাবেক্ষণ করাই বায়তুল মালের একমাত্র কাজ নয়। বরং সম্পদের সর্বোচ্চ সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করাই হবে তার প্রধান লক্ষ্য।
ইসলামী রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় অর্থ প্রশাসক ভবিষ্যতের প্রয়োজনের তুলনায় জনগণের বর্তমান প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেবে। ওমর (রা.) বায়তুল মালের সম্পদ ব্যয়ে এই নীতি অবলম্বন করতেন। ঐতিহাসিক ইবনুল জাওজি তাঁর সম্পর্কে বলেন, ‘ভবিষ্যতের জন্য সম্পদ জমা করে রাখা ওমর (রা.)-এর নীতি ছিল না। বরং তিনি সম্পদের অধিকারীদের হাতে তা দ্রুততম সময়ে পৌঁছে দিতেন। প্রতিবছর একবার তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য করার নির্দেশ দিতেন। ’ (মানাকিবু আমিরিল মুমিনিনা ওমর ইবনুল খাত্তাব, পৃষ্ঠা. ৭৯)
দক্ষ ও সৎ প্রশাসক নিয়োগ:
রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয়ে দক্ষ ও সৎ প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যাঁরা সততা ও দক্ষতার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয় করবেন। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর বর্ণনা থেকে তার একটি ধারণা লাভ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমি কি তোমাকে আমার ও এদের দৃষ্টান্ত সম্পর্কে বলব? আমাদের দৃষ্টান্ত হলো এমন একটি যাত্রীদলের মতো যারা তাদের সম্পদ একত্র করে এবং তাদের একজনের হাতে অর্পণ করে—যে প্রয়োজন অনুযায়ী খরচ করবে। এখন সেই ব্যক্তির জন্য কি বৈধ হবে কাউকে অগ্রাধিকার প্রদান করা?’ (মানাকিবু আমিরিল মুমিনিনা ওমর ইবনুল খাত্তাব, পৃষ্ঠা. ১০২)
ওমর ইবনুল আবদুল আজিজ (রহ.) রাষ্ট্রীয় কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অর্থে জ্বালানো প্রদীপ নিভিয়ে দিতেন। বলতেন, ‘আমি মুসলমানের সেবায় নিয়োজিত ছিলাম, তাই তাদের সম্পদ দিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়েছিলাম। এখন তুমি আমার অবস্থা জানতে চেয়েছ, তাই আমি আমার ব্যক্তিগত অর্থে প্রদীপ জ্বালালাম। ’ (আল ইকতিসাদুল ইসলামী, ২৫৬)
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা:
সম্পদ পুঞ্জীভূত করা ইসলামী অর্থনীতির মৌলিক দর্শনবিরোধী হলেও ইসলাম সম্পদের অপরিণামদর্শী ও অর্থহীন ব্যয় নিরুৎসাহ করে। বরং জনগণের প্রয়োজন পূরণ করার পর উদ্বৃত্ত অর্থ সংরক্ষণ করতে হবে এবং জনগণকে যেকোনো ধরনের দুর্যোগ ও সংকট থেকে রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকতে হবে। পবিত্র কোরআনে দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার একটি রূপরেখা পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘ইউসুফ বলল, তোমরা সাত বছর একাদিক্রমে চাষ করবে, অতঃপর তোমরা যে শস্য কর্তন করবে তা থেকে সামান্য পরিমাণ আহার করবে, তা ছাড়া পুরো শিষসহ রেখে দেবে। এরপর আসবে সাতটি কঠিন বছর। এই সাত বছর আগে সঞ্চয় করে রাখা শস্য খাবে। কেবল সামান্য অংশ, যা তোমরা সংরক্ষণ করবে তা ছাড়া। ’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৪৭-৪৮)
সুষম বণ্টন:
রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয়ে ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম মূলনীতি সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। জাকাত, খিরাজ, ওশর, জিজিয়াসহ ইসলামের অর্থনৈতিক বিধানগুলোর প্রধান লক্ষ্যই সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। যেন রাষ্ট্রের কতিপয় মানুষের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে না থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ জনপদবাসীর কাছ থেকে তাঁর রাসুলকে যা কিছু দিয়েছেন তা আল্লাহর, আল্লাহর রাসুলের, রাসুলের স্বজনদের, এতিমদের, অভাবগ্রস্ত ও পথচারীদের। যেন সম্পদ তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান তাদের মধ্যে আবর্তন না করে। ’ (সুরা : হাশর, আয়াত : ৭)
সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার:
ইসলামী রাষ্ট্র সম্পদের সর্বোচ্চ সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে। যেন রাষ্ট্রীয় সম্পদের পূর্ণ সুফল জনগণ লাভ করে। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কোনো খাতে—যেখানে সম্পদের যথাযথ ব্যবহার না-ও হতে পারে রাষ্ট্র তার সম্পদ ব্যয় করবে না। এ ব্যাপারে কোরআনের নির্দেশনা হলো, ‘তোমরা তোমাদের সম্পদ যা আল্লাহ তোমাদের জন্য উপজীবিকা করেছেন, তা নির্বোধদের হাতে অর্পণ কোরো না। …’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৫)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘যে সম্পদের ওপর মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল তা কোনো নির্বোধের হাতে তুলে দিতে নিষেধ করেছেন। এই ধরনের মানুষ কয়েক শ্রেণির হতে পারে। যেমন—বয়স কম হওয়ার কারণে, মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ার কারণে, ধর্মীয় জ্ঞান ও জাগতিক অভিজ্ঞতার অভাব থাকার কারণে, এমন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি—যে ঋণে নিমজ্জিত এবং তা পরিশোধের ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
সম্পদের অপচয় রোধ:
শুধু রাষ্ট্রীয় সম্পদ নয়; বরং ব্যক্তিগত সম্পদ অপচয়ে ইসলামের কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ কাজেও অপচয় ও অপব্যয় নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা খাও এবং পান করো, কিন্তু অপব্যয় করবে না। নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহ) অপব্যয়কারীকে পছন্দ করেন না। ’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩১)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য তিনটি জিনিস অপছন্দ করেন। অনর্থক গালগল্প, সম্পদের অপচয় ও বেশি বেশি প্রশ্ন করা। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৪৭৭)
অসদ্ব্যবহার রোধ:
রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যয়ের মতো অসদ্ব্যবহারও ইসলামে নিষিদ্ধ। কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে ব্যবহার করতে পারবে না। মহানবী (সা.) বলেন, ‘কিছু লোক আল্লাহর দেওয়া সম্পদ অন্যায়ভাবে ব্যয় করে, কিয়ামতের দিন তাদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩১১৮)
ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) কসম করে বলেন, ‘নিশ্চয়ই এই সম্পদে কেউ কারো চেয়ে বেশি হকদার নয়। আমিও কারো চেয়ে বেশি হকদার নই। এই সম্পদে সব মুসলমানের অধিকার রয়েছে, তবে মালিকানাধীন দাস ছাড়া। ’ (আল ফাতহুর রব্বানি, পৃষ্ঠা. ৮৭)
দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোরতা:
রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুফল লাভের পথে অন্যতম প্রধান অন্তরায় আর্থিক দুর্নীতি। ইসলাম দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। দুর্নীতির পথ খোলে এমন বৈধ বিষয়েও ইসলাম কঠোরতা আরো করেছে। মহানবী (সা.) এক ব্যক্তিকে জাকাত আদায়ের জন্য পাঠালে সে ব্যক্তিগত উপহার গ্রহণ করে। তখন তিনি তাকে বলেন, ‘তুমি কেন তোমার বাড়ি বসে থেকে অপেক্ষা করলে না যে তোমাকে উপহার দেয় কি না?’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৫৯৭)
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন, ‘তোমাদের যাকে আমি কোনো কাজে নিয়োগ দিই এবং সে একটি সুই বা তার চেয়ে বেশি কিছু গোপন করল, সে কিয়ামতের দিন তা আত্মসাতের সম্পদ হিসেবে উপস্থিত করা হবে। ’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৮৩৩)।
লেখক: আতাউর রহমান খসরু
রাষ্টীয় সম্পদ ব্যয়ে ইসলামে যে বিধিবিধান রয়েছে
প্রতিটি দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভর করে রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন ও যথাযথ ব্যবহারের ওপর। তাই ইসলাম রাষ্ট্রীয় সম্পদ যথার্থ ও ন্যায়সংগত ব্যবহার নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছে। মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর রাসুল (সা.) রাষ্ট্রীয় সম্পদের সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত করার প্রয়াস পান। একই সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রীয় সম্পদের সব ধরনের অপব্যয় ও অপরিণামদর্শী ব্যবহার বন্ধের উদ্যোগ নেন। রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে মহানবী (সা.) অর্থ প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং সম্পদের প্রবাহকে তিনি নিয়মাধীন করেন। যেন সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা যায়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সম্পদ যেন তোমাদের ধনীদের হাতে কুক্ষিগত হয়ে না যায়।’ (সুরা হাশর, আয়াত : ৭)
রাষ্ট্রীয় সম্পদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে মহানবী (সা.) ও পরবর্তী খলিফাদের কর্মপদ্ধতি থেকে যেসব নির্দেশনা পাওয়া যায় তার একটি সংক্ষিপ রূপরেখা তুলে ধরা হলো।
কেন্দ্রীয় অর্থব্যবস্থা
ইসলামি রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় অর্থব্যবস্থার নাম বায়তুল মাল। মহানবী (সা.)-এর মাধ্যমেই ইসলামি রাষ্ট্রের প্রথম কেন্দ্রীয় অর্থব্যবস্থা গড়ে ওঠে। মহানবী (সা.) অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কর্মী নিয়োগ দিতেন এবং তার কাছেই রাষ্ট্রের সমুদয় সম্পদ একত্র হতো। তবে সে সময় ইসলামি কেন্দ্রীয় অর্থব্যবস্থার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক নাম ছিল না। খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর আমলে এই কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার নামকরণ ‘বায়তুল মাল’ করা হয়। তিনি পূর্ণাঙ্গ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। (ইমাম তাবারি, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক : ২/৫১৯)
ইসলামি অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয়ে সুসংহত কেন্দ্রীয় অর্থব্যবস্থা অপরিহার্য। শুধু সম্পদ পুঞ্জীভূত করা বা রক্ষণাবেক্ষণ করাই বায়তুল মালের একমাত্র কাজ নয়। বরং সম্পদের সর্বোচ্চ সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা এর প্রধান লক্ষ্য। ইসলামি রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় অর্থ প্রশাসক ভবিষ্যতের প্রয়োজনের তুলনায় জনগণের বর্তমান প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেবে। ওমর (রা.) বায়তুল মালের সম্পদ ব্যয়ে এই নীতি অবলম্বন করতেন। ঐতিহাসিক ইবনুল জাওজি তার সম্পর্কে বলেন, ‘ভবিষ্যতের জন্য সম্পদ জমা করে রাখা ওমর (রা.)-এর নীতি ছিল না। বরং তিনি সম্পদের অধিকারীদের হাতে তা দ্রুততম সময়ে পৌঁছে দিতেন। প্রতি বছর একবার তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য করার নির্দেশ দিতেন।’ (মানাকিবু আমিরিল মুমিনিনা ওমর ইবনুল খাত্তাব, পৃষ্ঠা : ৭৯)
দক্ষ ও সৎ প্রশাসক নিয়োগ
রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয়ে দক্ষ ও সৎ প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া ইসলামি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যারা সততা ও দক্ষতার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয় করবেন। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর বর্ণনা থেকে তার একটি ধারণা লাভ করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, ‘আমি কি তোমাকে আমার ও এদের দৃষ্টান্ত সম্পর্কে বলব? আমাদের দৃষ্টান্ত হলো এমন একটি যাত্রী দলের মতো যারা তাদের সম্পদ একত্র করে এবং তাদের একজনের হাতে অর্পণ করে যে প্রয়োজন অনুযায়ী খরচ করবে। এখন সেই ব্যক্তির জন্য কি বৈধ হবে কাউকে অগ্রাধিকার প্রদান করা?’ (মানাকিবু আমিরিল মুমিনিনা ওমর ইবনুল খাত্তাব, পৃষ্ঠা : ১০২)
ওমর ইবনুল আবদুল আজিজ (রহ.) রাষ্ট্রীয় কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অর্থে জ্বালানো প্রদীপ নিভিয়ে দিতেন। বলতেন, ‘আমি মুসলমানের সেবায় নিয়োজিত ছিলাম, তাই তাদের সম্পদ দিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়েছিলাম। এখন তুমি আমার অবস্থা জানতে চেয়েছ, তাই আমি আমার ব্যক্তিগত অর্থে প্রদীপ জ্বালালাম।’ (আল ইকতিসাদুল ইসলামি, ২৫৬)
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা
সম্পদ পুঞ্জীভূত করা ইসলামি অর্থনীতির মৌলিক দর্শনবিরোধী হলেও ইসলাম সম্পদের অপরিণামদর্শী ও অর্থহীন ব্যয় নিরুৎসাহ করে। বরং জনগণের প্রয়োজন পূরণ করার পর উদ্বৃত্ত অর্থ সংরক্ষণ করতে হবে এবং জনগণকে যেকোনো ধরনের দুর্যোগ ও সংকট থেকে রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকতে হবে। পবিত্র কোরআনে দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার একটি রূপরেখা পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘ইউসুফ বলল, তোমরা সাত বছর একাদিক্রমে চাষ করবে, অতঃপর তোমরা যে শস্য কর্তন করবে তা থেকে সামান্য পরিমাণ আহার করবে, বাকীটা পুরো শিষসহ রেখে দেবে। এরপর আসবে সাতটি কঠিন বছর। এই সাত বছর আগে সঞ্চয় করে রাখা শস্য খাবে। কেবল সামান্য অংশ, যা তোমরা সংরক্ষণ করবে তা ছাড়া।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত : ৪৭-৪৮)
সুষম বণ্টন
রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয়ে ইসলামি অর্থনীতির অন্যতম মূলনীতি সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। জাকাত, খিরাজ, ওশর, জিজিয়াসহ ইসলামের অর্থনৈতিক বিধানগুলোর প্রধান লক্ষ্যই সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। যেন রাষ্ট্রের কতিপয় মানুষের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে না থাকে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ জনপদবাসীর কাছ থেকে তার রাসুলকে যা কিছু দিয়েছেন তা আল্লাহর, আল্লাহর রাসুলের, রাসুলের স্বজনদের, এতিমদের, অভাবগ্রস্ত ও পথচারীদের। যেন সম্পদ তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান তাদের মধ্যে আবর্তন না করে।’ (সুরা হাশর, আয়াত : ৭)
সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার
ইসলামি রাষ্ট্র সম্পদের সর্বোচ্চ সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে। যেন রাষ্ট্রীয় সম্পদের পূর্ণ সুফল জনগণ লাভ করে। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কোনো খাতে যেখানে সম্পদের যথাযথ ব্যবহার না-ও হতে পারে রাষ্ট্র তার সম্পদ ব্যয় করবে না। এ ব্যাপারে কোরআনের নির্দেশনা হলো, ‘তোমরা তোমাদের সম্পদ যা আল্লাহ তোমাদের জন্য উপজীবিকা করেছেন, তা নির্বোধদের হাতে অর্পণ কোরো না। …’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৫)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘যে সম্পদের ওপর মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল তা কোনো নির্বোধের হাতে তুলে দিতে নিষেধ করেছেন। এই ধরনের মানুষ কয়েক শ্রেণির হতে পারে। যেমন বয়স কম হওয়ার কারণে, মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ার কারণে, ধর্মীয় জ্ঞান ও জাগতিক অভিজ্ঞতার অভাব থাকার কারণে, এমন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যে ঋণে নিমজ্জিত এবং তা পরিশোধের ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
সম্পদের অপচয় রোধ
শুধু রাষ্ট্রীয় সম্পদ নয়; বরং ব্যক্তিগত সম্পদ অপচয়ে ইসলামের কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ কাজেও অপচয় ও অপব্যয় নিষিদ্ধ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা খাও এবং পান করো, কিন্তু অপব্যয় করবে না। নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহ) অপব্যয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৩১)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য তিনটি জিনিস অপছন্দ করেন। অনর্থক গালগল্প, সম্পদের অপচয় ও বেশি বেশি প্রশ্ন করা।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৪৭৭)
অপব্যবহার রোধ
রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যয়ের মতো অপব্যবহারও ইসলামে নিষিদ্ধ। কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে ব্যবহার করতে পারবে না। মহানবী (সা.) বলেন, ‘কিছু লোক আল্লাহর দেওয়া সম্পদ অন্যায়ভাবে ব্যয় করে, কিয়ামতের দিন তাদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩১১৮)
ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) কসম করে বলেন, ‘নিশ্চয়ই এই সম্পদে কেউ কারও চেয়ে বেশি হকদার নয়। আমিও কারও চেয়ে বেশি হকদার নই। এই সম্পদে সব মুসলমানের অধিকার রয়েছে, তবে মালিকানাধীন দাস ছাড়া।’ (আল ফাতহুর রব্বানি, পৃষ্ঠা : ৮৭)
দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোরতা
রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুফল লাভের পথে অন্যতম প্রধান অন্তরায় আর্থিক দুর্নীতি। ইসলাম দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। দুর্নীতির পথ খোলে এমন বৈধ বিষয়েও ইসলাম কঠোরতা আরোপ করেছে। মহানবী (সা.) এক ব্যক্তিকে জাকাত আদায়ের জন্য পাঠালে সে ব্যক্তিগত উপহার গ্রহণ করে। তখন তিনি তাকে বলেন, ‘তুমি কেন তোমার বাড়ি বসে থেকে অপেক্ষা করলে না যে কেউ তোমাকে উপহার দেয় কি না?’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৫৯৭)
রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘তোমাদের যাকে আমি কোনো কাজে নিয়োগ দিই এবং সে একটি সুই বা তার চেয়ে বেশি কিছু গোপন করল, সে কিয়ামতের দিন তা আত্মসাতের সম্পদ হিসেবে উপস্থিত করা হবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৮৩৩)
+ There are no comments
Add yours